মিউজিক কি হালাল – Is music Halal in Islam

মিউজিক কি হালাল

১ম পর্ব

মিউজিক কি হালাল - Is music Halal in Islam

মিউজিক কি হালাল ? গান ও মিউজিকের ব্যাপারে ইসলামের হুকুম কী? এটি একটি তুমুল আলোচিত প্রশ্ন। বলা যায় এই প্রশ্নে মুসলিমরা দ্বিধাবিভক্ত। একদল বাছবিচার ছাড়াই সব ধরনের গান ও মিউজিক গভীর আগ্রহে শোনে। কারণ তারা মনে করে গান অন্যান্য হালাল বস্তুর মতোই হালাল; আল্লাহ তায়ালা এটাকে তাঁর বান্দাদের জন্য হারাম করেননি। বিপরীতে আরেক দল সব ধরণের গানকেই নিষিদ্ধ মনে করেন। গানের শব্দ কানে এলেই তারা নিজের কান চেপে ধরেন। তারা বলেন, গান হলো শয়তানের বাঁশি ও বেহুদা কথা, যা আল্লাহর যিকির ও নামাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখে; বিশেষত গায়ক যদি হয় কোনো নারী। কারণ, তাদের মতে নারীর কণ্ঠস্বর এমনিতেই সতরের অন্তর্ভুক্ত। সেই কণ্ঠে গান গাওয়া হলে তা এমনিতেই হারামের পর্যায়ে হবে। তারা তাদের অভিমতের পক্ষে কুরআনের কয়েকটি আয়াত, রাসূলের কিছু হাদিস এবং কতক আলিমের মতামত দলিল হিসেবে পেশ করেন।

আবার তাদের কেউ যেকোনো ধরনের মিউজিক প্রত্যাখ্যান করেন, এমনকি টেলিভিশনে সংবাদের পূর্বে প্রচারিত মিউজিককেও বর্জন করেন। তৃতীয় আরেক দল এ উভয় দলের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন। তারা কখনও এক পক্ষে, আবার কখনও অন্য পক্ষে অবস্থান নেন। তারা অবশ্য এ বিষয়ে আলিমদের কাছে প্রশান্তিদায়ক চূড়ান্ত ফতোয়া কামনা করেন। কারণ, বিষয়টি মানুষের আবেগ-অনুভূতি ও দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। বিশেষত শ্রবণীয় ও দর্শনীয় প্রচারমাধ্যম মানুষের বাড়িঘরে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় প্রবেশ করেছে; এর ফলে গান-মিউজিকও ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাদের শ্রবণেন্দ্রিয়কে আকৃষ্ট করছে। তাই তারা গান ও মিউজিক সম্পর্কে মনে প্রশান্তি আসার মতো ফয়সালা প্রত্যাশা করেন।

মিউজিক সহ ও মিউজিক ছাড়া গান এমন একটা বিষয়, যা নিয়ে আলিমদের মধ্যেই তর্ক-বিতর্ক দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। তারা কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছেন, আবার কিছু বিষয়ে মতভেদে লিপ্ত রয়েছেন। তারা ওইসব গান হারাম হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছেন- যাতে অশ্লীলতা ও ফাসিকি বিদ্যমান এবং যা গুনাহর দিকে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ, গানের কথাই তো মূল- তার মধ্যে যা ভালো তা ভালোই, আর যা মন্দ তা মন্দই । যেসব উক্তিতে হারাম কিছু রয়েছে তা হারাম। অতএব, তার সাথে যদি ছন্দ, সুর ও হৃদয়গ্রাহী কিছু থাকে, তাহলে তার বিধান কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। একইভাবে তারা অশ্লীলতা ও ফাসিকিমুক্ত গান হালাল হওয়ার ব্যাপারেও ঐকমত্যে উপনীত হয়েছেন- যা বাদ্যযন্ত্রমুক্ত ও উত্তেজক নয় এমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গাওয়া হয়ে থাকে। আর তা যদি হয় বৈধ আনন্দ-বিনোদনের স্থানে, যথা— বিয়ের অনুষ্ঠানে, কাউকে স্বাগত জানানোর সময়, ঈদের দিন ইত্যাদিতে। তবে শর্ত হলো তা পরপুরুষের সামনে কোনো নারীর কণ্ঠে গাওয়া যাবে না। এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু সুস্পষ্ট কুরআনের আয়াত ও হাদিস রয়েছে; আমরা পরে তা আলোচনা করব। এ ছাড়া বাকি অন্যান্য গানের ব্যাপারে তারা সুস্পষ্ট মতপার্থক্যে লিপ্ত। তাদের মধ্যে কেউ সব ধরনের গানকে হালাল বলেন- তা বাদ্যযন্ত্র সহ হোক কিংবা

বাদ্যযন্ত্র বিহীন। আর কেউ কেউ সব ধরনের গান-বাজনা হারাম ঘোষণা করেন— তা বাদ্যযন্ত্র সহ হোক বা বাদ্যযন্ত্র ছাড়া। এমনকি তারা তা কবিরা গুনাহ বলেও উল্লেখ করেছেন। বিষয়টির গুরুত্বের কারণে মিউজিক কি হালাল এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা জরুরি  মনে করি। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ প্রসঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা করাও আবশ্যক মনে করি- যাতে মুসলিমরা অকাট্য দলিলের অনুসরণ করে হালাল ও হারাম আলাদা করে নিতে পারে। তাদের যেন কারও কথার অন্ধ অনুসরণ করতে না হয়। তারা যেন দলিলের ভিত্তিতে এ বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন হতে পারে এবং যথার্থ অবস্থান গ্রহণ করতে পারে।

সাধারণত সবকিছুই হালাল

আলোচনার শুরুতে আমাদের একটি মূলনীতি জেনে নেওয়া আবশ্যক। তা হলো- আলিমগণ এ সিদ্ধান্তে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে, মূলত সকল বস্তু হালাল । কারণ, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-

هُوَ الَّذِيْ خَلَقَ لَكُمْ مَّا فِى الْاَرْضِ جَمِيْعًا

“তিনিই তোমাদের জন্য পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।” সূরা বাকারা : ২৯

কাজেই সুস্পষ্ট বিশুদ্ধ নস (কুরআন-সুন্নাহর উক্তি) কিংবা নির্ভরযোগ্য প্রমাণিত ইজমা (আলেমদের সম্মিলিত সিন্ধান্ত) ছাড়া কোনো কিছু হারাম হতে পারে না। অতএব, নস ও ইজমা না থাকলে; অথবা নস সুস্পষ্ট, কিন্তু সহিহ না হলে; কিংবা সহিহ, কিন্তু সুস্পষ্ট না হলে; সে নস কোনো কিছু হালাল হওয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে না। এ অবস্থায় বস্তুটি বিস্তৃত হালালের গণ্ডিতেই থাকবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلَّا مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ ۗ

“তোমাদের জন্য যা হারাম করা হয়েছে, তা বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলোও হালাল যদি তোমরা

নিরুপায় হয়ে যাও।” সূরা আনআম : ১১৯

 রাসূল সা. বলেছেন,

“যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাবে হালাল করেছেন তা হালাল, আর যা হারাম করেছেন তা হারাম। আর যেসব বিষয়ে নিরবতা অবলম্বন করেছেন তা ক্ষমাকৃত। সুতরাং তোমরা আল্লাহর ক্ষমাকৃত বস্তু গ্রহণ করো। কারণ, আল্লাহ কোনো কিছু ভুলে যান না।”[1]

অতঃপর রাসূল সা. তিলাওয়াত করেন-

وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا ۚ

তোমার রব কোনো কিছু ভুলে যান না’ আয়াতটি।” সূরা মারইয়াম : ৬৪

রাসূল সা. আরও বলেছেন,

“আল্লাহ তায়ালা কিছু কাজ ফরজ করে দিয়েছেন, তোমরা তা কখনও বর্জন করেবে না। আর কিছু ব্যাপারে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তা লঙ্ঘন করবে না। তিনি দয়াপরবশ হয়ে (ভুলে গিয়ে নয়) কিছু ব্যাপারে নীরব থেকেছেন, সেসব ব্যাপারে অনুসন্ধান করবে না।[2]

এটি যেহেতু শরিয়াহর একটি মূলনীতি, তাই কোন নস বা দলিলের ওপর ভিত্তি করে কেউ গান হারাম ঘোষণা করেছেন, আবার কেউ গানকে বৈধ ঘোষণা করেছেন- তা জানা আবশ্যক।

মিউজিক কি হালাল - Is music Halal in Islam

 

গান হারাম ঘোষণাকারীদের দলিল তার পর্যালোচনা

. গান হারাম ঘোষণাকারীগণ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও কোনো কোনো তাবেয়ি থেকে বর্ণিত এক বর্ণনার ওপর নির্ভর করেছেন। তারা নিম্নোক্ত আয়াতকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করে গান হারাম বলে মন্তব্য করেছেন-

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَّشْتَرِيْ لَهْوَ الْحَدِيْثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيْلِ اللّٰهِ بِغَيْرِ عِلْمٍۖ وَّيَتَّخِذَهَا هُزُوًاۗ اُولٰۤىِٕكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ 

“এক শ্রেণির লোক মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা (লাহওয়াল হাদিস) সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং তা দ্বারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্যই অবমাননাকর শাস্তি।” সূরা লুকমান : ৬

তারা এ আয়াতের ‘লাহওয়াল হাদিস’ (অবান্তর কথাবার্তা)- পরিভাষাটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন-গান। এ ব্যাখ্যার পর্যালোচনায় ইমাম ইবনে হাযম বলেন,

“কয়েকটি কারণে এ দলিল গ্রহণযোগ্য নয়—

এক. রাসূল সা. ছাড়া আর কারও কথা হুজ্জত বা প্রমাণ নয়।

দুই. অপরাপর সাহাবি ও তাবেয়িগণ এ ব্যাখ্যার সাথে দ্বিমত করেছেন।

তিন. স্বয়ং আয়াতের বাক্যাবলিই তাদের এ ব্যাখ্যাকে বাতিল করে। কারণ, তাতে বলা হয়েছে—

‘এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে।’

নিঃসন্দেহে যারা এ কাজ করবে তারা তো কাফিরই গণ্য হবে। কেননা, তারা আল্লাহর পথকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের লক্ষ্যবস্তু বানায় ।”

ইমামা ইবনে হাজম আরও বলেন, “কোনো মানুষ যদি এ উদ্দেশ্যে আল-কুরআনও খরিদ করে যে, তা দ্বারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করবে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করবে, তাহলেও সে কাফির হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে এরূপ কর্মেরই নিন্দা করেছেন। আর যারা অবান্তর কথাবার্তা বা গান আনন্দ-বিনোদন ও মনে প্রশান্তি আনার জন্য খরিদ করে, আর এর মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্য না থাকে- এ আয়াতে তাদের নিন্দা করা হয়নি। অতএব, তাদের উপর্যুক্ত বক্তব্যের সাথে আয়াতের সম্পর্ক নেই বলে প্রমাণিত হলো। তেমনিভাবে যারা কুরআন তিলাওয়াত, হাদিস অধ্যয়ন, অবান্তর কথাবার্তা, গানবাজনা কিংবা অন্য যেকোনো কাজে ব্যস্ত থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ছেড়ে দেয়, তারা ফাসিক ও আল্লাহর নাফরমান। আর যারা উপর্যুক্ত যেকোনো কাজে সময় কাটায়, কিন্তু কোনো ফরজ কাজ থেকে গাফেল হয়ে পড়ে না, তারা অবশ্যই সৎকর্মশীল।”[3]

. মিউজিক কি হালাল ? এই প্রশ্নে একদল গান হতে বিরত থাকা ওয়াজিব মনে করে। তারা মুমিনের প্রশংসায় অবতীর্ণ এ আয়াতকেও দলিল হিসেবে নিয়েছেন-

وَاِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ اَعْرَضُوْا عَنْهُ

“যখন তারা (মুমিনরা) অনর্থক কোনো কথাবার্তা শুনে, তা এড়িয়ে যায়।” সূরা কাসাস : ৫৫

এ বক্তব্যের পর্যালোচনায় বলা যায়, এ আয়াতের স্বাভাবিক অর্থ হলো- এখানে اللّغو  বা অনর্থক কথাবার্তা বলতে গালাগালি, ভর্ৎসনা, তিরস্কার জাতীয় মন্দ কথা বোঝানো হয়েছে। আয়াতের বাকি অংশ তা-ই প্রমাণ করে-

 وَاِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ اَعْرَضُوْا عَنْهُ وَقَالُوْا لَنَآ اَعْمَالُنَا وَلَكُمْ اَعْمَالُكُمْ ۖسَلٰمٌ عَلَيْكُمْ ۖ لَا نَبْتَغِى الْجٰهِلِيْنَ

“তারা যখন অবাঞ্ছিত কথাবার্তা শুনে, তা এড়িয়ে যায় এবং বলে- আমাদের জন্য আমাদের কাজ এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ। তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা অজ্ঞদের সাথে জড়িত হতে চাই না।” সূরা কাসাস : ৫৫

মূলত আয়াতটি রহমানের বান্দাহদের প্রশংসায় আসা এ আয়াতের মতোই-

وَّاِذَا خَاطَبَهُمُ الْجٰهِلُوْنَ قَالُوْا سَلٰمًا

“যখন অজ্ঞ লোকেরা তাদের সম্বোধন করে, তখন তারা বলে- তোমাদের প্রতি সালাম।” সূরা ফুরকান : ৬৩

যদি আমরা ধরেই নিই যে, উক্ত আয়াতের বা অনর্থক কথাবার্তা গানকেও শামিল করে; তাহলেও আমরা দেখতে পাই যে, আয়াতটি গান শোনা থেকে শব্দটি বিরত থাকা মুস্তাহাব প্রমাণ করে, ওয়াজিব প্রমাণ করে না। কারণ, اللّغو শব্দের মতোই ‘অনর্থক’ অর্থ দেয়। আর অনর্থক কিছু শোনা হারাম নয়, যতক্ষণ না কারও হক বিনষ্ট হয় বা তা কোনো ওয়াজিব কর্ম থেকে বিরত রাখে।

ইবনে জুরাইয গান শোনা বৈধ মনে করতেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘গান কিয়ামত দিবসে আপনার সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত হবে, না অসৎকর্মের?’ তিনি বললেন, ‘তা না সৎকর্মের আর না অসৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ, তা তো اللّغو বা অনর্থক কথার মতোই।

আল্লাহ তায়ালা বলেন-

لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللّٰهُ بِاللَّغْوِ فِيْٓ اَيْمَانِكُمْ

“আল্লাহ পাক তোমাদের বা অর্থহীন শপথের জন্য পাকড়াও করবেন না।” সূরা বাকারা : ২২৫, সূরা মায়িদা : ৮৯

ইমাম গাযালি বলেন, “যদি আল্লাহর নামে অর্থহীন শপথ করার কারণে (যাতে দৃঢ় প্রত্যয় ও ইচ্ছা থাকে না এবং বিরোধিতা করার চিন্তাভাবনাও থাকে না) আল্লাহ তায়ালা কাউকে পাকড়াও না করেন; তা হলে কি করে ভাবতে পারি যে, গান গাওয়ার জন্য পাকড়াও করবেন?”[4]

 

আমরা বলতে চাই, সব গান অর্থহীনও নয়। গানের হুকুম হবে তার গায়ক ও শ্রোতার নিয়ত অনুযায়ী। সৎ নিয়ত খেলাধুলা ও রসিকতাকেও ইবাদত এবং সৎকর্মে পরিণত করে। আর মন্দ নিয়ত বাহ্যত ইবাদতকে ধ্বংস ও পণ্ড করে দেয়, যেমন প্রদর্শনেচ্ছাযুক্ত ইবাদত-

“আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেহারা ও বাহ্য আমলের দিকে তাকান না; তিনি তাকান তোমাদের অন্তর ও প্রদর্শন ইচ্ছাহীন আমলের দিকে।”[5]

আমরা এখানে ইমাম ইবনে হাযমের আল-মুহাল্লায় উল্লিখিত একটি চমৎকার উক্তি উল্লেখ করতে চাই। তিনি কথাটি গান নিষিদ্ধ সাব্যস্তকারীদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেই বলেছেন,

“তারা বলেন, গান কি হক না নাহক? তৃতীয় কোনো কিছু হওয়ার তো অবকাশ নেই! কারণ, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-

فَمَاذَا بَعْدَ الْحَقِّ اِلَّا الضَّلٰلُ

“হকের পর গোমরাহি ছাড়া তো আর কিছু নেই।” সূরা ইউনুস : ৩২

এ প্রসঙ্গে আমাদের জবাব হলো- রাসূল সা. বলেছেন, ‘আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল । প্রত্যেকেই তাই পাবে যা সে নিয়ত করে।[6]

সুতরাং যে আল্লাহর নাফরমানির উদ্দেশ্যে গান শোনার নিয়ত করবে, সে ফাসিক। অন্যসব বিষয়েও একই কথা। আর যে মানসিক প্রশান্তি পেতে, আল্লাহর ইবাদত- বন্দেগির জন্য নিজেকে সতেজ করতে কিংবা ভালোকাজে নিজেকে সক্রিয় করার উদ্দেশ্যে গান শুনবে, সে আল্লাহর আনুগত্যকারী সৎকর্মশীল বলে গণ্য হবে। তার এ কর্মও সত্য এবং হক বলে পরিগণিত হবে। আর যে ব্যক্তি গান শোনার ক্ষেত্রে কোনো ইবাদত বা নাফরমানির নিয়ত করে না, তার সে গান শোনা হবে অর্থহীন বৈধ কর্ম। যেমন- বাগানে পয়চারি করা, বাড়ির আঙিনায় নিরিবিলি বসে থাকা, পোষাকে বিভিন্ন কালার ব্যবহার ইত্যাদি কাজ । এগুলো যেমন বৈধ, গান শোনাও ঠিক তেমনই বৈধ।[7]

মিউজিক কি হালাল - Is music Halal in Islam

. মিউজিক কি হালাল ? এই প্রসঙ্গে যারা মিউজিককে হারাম মনে করেন, তারা এই হাদিস দ্বারাও দলিল পেশ করেন-

“মুমিনের জন্য তিন ধরনের খেল-তামাশা ছাড়া বাকি সব খেল-তামাশা বাতিল। নিজ স্ত্রীর সাথে খেল-তামাশা, নিজের ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দান এবং নিজের তির থেকে তির নিক্ষেপ করা ।”[8]

তারা বলেন, গান যেহেতু এই তিনটির বাইরের বিনোদন, সুতরাং তা বাতিল ও অবৈধ।

যারা গান বৈধ বলে অভিমত পোষণ করেন, তারা এর জবাবে বলেন- উপর্যুক্ত হাদিসটি দুর্বল। আর হাদিসটি সহিহ হলেও তা গান হারাম হওয়ার দলিল হবে না। কারণ, হাদিসে ব্যবহৃত ‘বাতিল’ শব্দটি হারাম বোঝায় না; বরং তা অর্থহীন কর্ম বোঝায়। আবু দারদা রা. বলেন,

“আমি নিজেকে কখনও কখনও বাতিল কাজে ন্যস্ত করি- যাতে এর মাধ্যমে হক কাজ করার শক্তি পাই।”

তা ছাড়া হাদিসটির উদ্দেশ্য কেবল এ তিনটি কাজকে সীমাবদ্ধ করাও নয়। কারণ, সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত মসজিদে নববিতে রাসূল (সা.) হাবশিদের খেলা প্রদর্শন এবং তা থেকে আনন্দ উপভোগ করেছিলেন। হাবশিদের এই ছিল খেলা উপর্যুক্ত তিন ধরণের বাইরের একটি খেলাধুলা। তা ছাড়া বাগানে বা পার্কে ঘোরাফেরা করা, পাখ-পাখালির কাকলি শোনা অথবা খেলাধুলা করা ইত্যাদির মতো যেসব কর্ম দ্বারা মানুষ সাধারণত নিষ্কলুষ আনন্দ-বিনোদন উপভোগ করে তার কিছুই হারাম নয়; যদিও এসব কাজকে বাতিল ও অনর্থক কাজ বলা যায় ।

মিউজিক কি হালাল (২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন)

তথ্য সূত্র :

[1] হাকিম আবু দারদা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন এবং সহিহ বলে মন্তব্য করেছেন। হাদিসটি বাযযারও বর্ণনা করেছেন

[2] দারে কুতনি কর্তৃক আবু সালাবা আল খশনি থেকে বর্ণিত। হাফেজ আবু বকর মুসআলি তাঁর আমানি নামক গ্রন্থে আর ইমাম নববি তাঁর আরবাঈন গ্রন্থে হাদিসটি হাসান বলে মন্তব্য করেছেন।

[3] ইবনে হাযম, আল মুহাল্লা, (মুনিরিয়া) ৯, পৃ. ৬০

[4] গাযালি, এহইয়াউ উলুমুদ্দিন, (মিশর : দারুশ শাবাব), কিতাবুস সিমা, পৃ. ১১৪৭

[5] আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত। মুসলিম : কিতাবুল ওয়াছিলা ওয়াল আদাব, বাবু তাহরিমু যুলমিল মুসলিম।

[6] বুখারি, মুসলিম। উমর ইবনে খাত্তাব রা. বর্ণিত।

[7] ইবনে হাযম, আল মুহাল্লা, খণ্ড ৯, পৃ. ৬০

[8] হাদিসটি চার সুনানে বর্ণিত হয়েছে। এর সনদে ইজতিরাব বা বিভ্রাট রয়েছে। হাফেজ ইরাকি এ কথা বলেন এহইয়াউ উলুমুদ্দিন-এর তাখরিজে।

 

 মিউজিক কি হালাল

ড. ইউসুফ আল কারজাভি

Leave a Comment