মিউজিক কি হালাল – Is music Halal in Islam

মিউজিক কি হালাল

২য় পর্ব

[মিউজিক কি হালাল-১ম পর্ব]

মিউজিক কি হালাল – Is music Halal in Islam

গত পর্বের পর

. মিউজিক কি হালাল – Is music Halal in Islam? এই প্রশ্নের সাপেক্ষে যারা মিউজিক ও গানকে হারাম মনে করেন, তারা পূর্বোক্ত দলিলগুলোর সাথে ইমাম বুখারি কর্তৃক আবু মালিক ও আবু আমির আশআরির বরাতে মুআল্লাক সনদে রাসূল সা. থেকে বর্ণিত হাদিস দ্বারাও দলিল দিয়ে থাকেন। সে হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,

“অচিরেই আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক হবে, যারা ব্যভিচার, রেশমি পোশাক, মদ ও মাআযিফকে হালাল মনে করবে।”

তাদের মতে ‘মাআযিফ’ শব্দের অর্থ হলো বাদ্যযন্ত্র ও খেলাধুলা। এ হাদিসটি সহিহ বুখারিতে থাকলেও ধারাবাহিক সনদে বর্ণিত নয়; বরং মুআল্লাক তথা বিচ্ছিন্ন সনদে বর্ণিত। এই কারণেই ইমাম ইবনে হাযম এ হাদিসটিকে দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। তা ছাড়া তিনি আরও বলেছেন, এ হাদিসটির সনদ এবং মতনও ইজতিরাব তথা বিভ্রাটমুক্ত নয়।

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি হাদিসটি মুত্তাসিল (ধরাবাহিক সনদযুক্ত) প্রমাণ করার জন্য চেষ্টা করেছেন এবং তিনি তা নয়টি মুত্তাসিল সনদে বর্ণনাও করেছেন। তবে সব সনদেই এমন একজন রাবি আছেন, যার সম্পর্কে হাদিস যাচাই শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞগণ নানান কথা বলেছেন। তিনি হলেন হিশাম ইবনে আম্মার।[1] তিনি দামেশকের একজন খতিব, আলিম, মুহাদ্দিস ও কারি ছিলেন। ইবনে মুঈন ও আল আজালি তাকে নির্ভরযোগ্য রাবি বলে মন্তব্য করলেও ইমাম আবু দাউদ তার সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন- “তিনি ভিত্তিহীন চল্লিশটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।”

আবু হাতিম বলেন, “তিনি সত্যবাদী, তবে তার অবস্থার পরিবর্তন হয়েছিল। তার কাছে যা কিছু দেওয়া হয়েছিল তিনি সবকিছু পড়েছিলেন, আর যা কিছু শুনানো হয়েছিল তা সবই গ্রহণ করেছিলেন।” ইবনে সাইয়ারও তার সম্পর্কে এরূপ মন্তব্য করেছেন।

ইমাম আহমাদ তার সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “তিনি বাউণ্ডুলে, হালকা স্বভাবের মানুষ।” ইমাম নাসায়ি বলেন, “তাকে নিয়ে তেমন সমস্যা নেই” (তবে এ বক্তব্য তাকে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ করে না)। হাফেজ যাহাবি তার পক্ষাবলম্বন করা সত্ত্বেও বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, “তিনি সত্যবাদী এবং বেশি হাদিস বর্ণনাকারী হলেও তার বর্ণিত এমন কিছু হাদিস আছে, যা মুনকার (দুর্বল) পর্যায়ের।[2] তাঁর সম্বন্ধে আরও মন্তব্য করা হয়েছে যে, “তিনি পারিশ্রমিক ছাড়া কোনো হাদিস বর্ণনা করতেন না।”

কোনো বিতর্কিত বিষয়ে এ ধরনের ব্যক্তির হাদিস গ্রহণ করা যায় না। বিশেষত তা যদি হয় এমন বিষয়, যা সর্বসাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

এ তো গেল হাদিসটি সহিহ হওয়ার ব্যাপারে কথা। হাদিসটির তাৎপর্য ও অর্থের ব্যাপারেও নানা কথা আছে। হাদিসে উল্লেখিত ‘মাআযিফ’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ কী— সে ব্যাপারেও কোনো ঐকমত্য হয়নি। বলা হয়েছে, এর অর্থ হলো- খেলাধুলা। এ অর্থটি অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্টবাচক। আর কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ হলো- ছয় বা আট তারের গোলাকৃতির বাদ্যযন্ত্র বিশেষ । যদি ধরে নিই যে তার অর্থ বাদ্যযন্ত্র, তাহলেও বুখারির উক্ত মুআল্লাক হাদিসটির বাক্য সুস্পষ্টভাবে মাআযিফ বা বাদ্যযন্ত্রকে হারাম প্রমাণ করে না।

কারণ, ইবনে আরাবির মতে, “হাদিসের ‘হালালজ্ঞান করবে’- বাক্যটির দুই ধরনের অর্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথম অর্থ হলো, তারা মনে করবে এসব কর্ম হালাল। আর দ্বিতীয় অর্থটি হলো রূপক; অর্থাৎ এসব জিনিস তারা ব্যাপকহারে ব্যবহার করবে। যদি প্রথম অর্থটি অর্থাৎ ‘হালালজ্ঞান করবে’ এটাই এ হাদিসের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তো তারা কাফির হয়ে যাবে! কারণ, ইজমা মতে নিশ্চিত হারাম জিনিসকে যথা- মদ, যিনা, ইত্যাদিকে হালাল বলে বিশ্বাস করা কুফরি।”

আর যদি আমরা মেনে নিই যে তা হারাম বোঝায়, তাহলে তা থেকে কি বোঝা যায় যে, উক্ত সবকিছু যথা- যিনা, রেশম, মদ, বাদ্যযন্ত্র সম্মিলিতভাবেই হারাম? নাকি প্রত্যেকটি আলাদা আলাদাভাবেই হারাম? প্রথম অর্থটি সঠিক ও অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। কারণ হাদিসটি প্রকৃতপক্ষে এমন একদল মানুষের স্বভাব বোঝানোর জন্য ব্যক্ত হয়েছে, যারা লাল রজনিতে মদ্য পান করে মাতাল হয়ে থাকে। নারী, মাদকদ্রব্য, গান-বাজনা, রেশমি পোশাক ও ব্যভিচার ইত্যাদিতে মত্ত থাকে।

ইবনে মাজাহ হাদিসটি আবু মালেক আশআরি থেকে নিম্নোক্ত ভাষায় বর্ণনা করেছেন,

“আমার উম্মতের মধ্যে কিছু লোক মদ পান করবে, যারা একে অন্য নাম দেবে। তাদের মাথার ওপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকাদের গান গাওয়া হবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের নিয়ে পৃথিবী ধ্বংস করবেন এবং তাদের মধ্য হতে বানর ও শূকর বানানো হবে।”

হাদিসটি ইবনে হিব্বান তাঁর সহিহ-তে এবং ইমাম বুখারি তাঁর তারিখ-এ বর্ণনা করেছেন। অন্যান্য বর্ণনাকারীদের যারাই হাদিসটি হিশাম ইবনে আম্মারের সূত্র ছাড়া অন্য সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তারা মূলত মদ্যপানের জন্য তিরস্কারের কথা উল্লেখ করেছেন। আর ‘মাআযিফ’ বা বাদ্যযন্ত্রের কথা তার অনুগামী ও পরিপূরক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

মিউজিক কি হালাল

ঙ. মিউজিক কি হালাল – Is music Halal in Islam? এই প্রসঙ্গে যারা মিউজিককে হারাম বলে অভিমত পোষণ করেন, তারা আয়িশা রা.-এর নিন্মোক্ত হাদিস দ্বারাও দলিল দিয়ে থাকেন-

“আল্লাহ তায়ালা গায়িকা, দাসীর বেচাকেনা, তার মূল্য গ্রহণ এবং তাকে গান শেখানো হারাম করেছেন।”

এর জবাব হলো- প্রথমত : হাদিসটি দুর্বল, এমনকি গায়িকা দাসীর ক্রয়-বিক্রয় সম্বন্ধে যেসব হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তা সবই দুর্বল।[3]

দ্বিতীয়ত : ইমাম গাযালি বলেন, হাদিসে যে দাসীর কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা সেসব দাসীর কথাই বোঝানো হয়েছে, যারা পানশালায় পুরুষদের গান গেয়ে শোনায়। পরনারীর জন্য ফাসিক-ফাজির এবং যাদের ফিতনায় পড়ার আশঙ্কা আছে তাদেরকে গান শোনানো হারাম। তারা ফিতনা বলতে নিষিদ্ধ কর্ম বুঝিয়ে থাকেন। এ হাদিস থেকে দাসী কর্তৃক তার মালিককে গান শোনানো হারাম সাব্যস্ত করা যায় না। একইসাথে ফিতনার সম্ভাবনা না থাকলে মালিক ছাড়া অন্য কাউকে গান শোনানোর বিষয়টিও হারাম প্রমাণিত হয় না। বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত আয়িশা রা.-এর বাড়িতে দুই দাসীর গান করা সংক্রান্ত হাদিসটি তাই প্রমাণ করে।[4]

তৃতীয়ত : ওইসব গায়িকা দাসী ছিল দাসপ্রথার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যে দাসপ্রথাকে ইসলাম ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করতে চেয়েছিল। ইসলামের এই চিন্তা- দর্শনের সাথে ইসলামি সমাজে তাদের বাকি রেখে তাদের বেচা-কেনা করা সংগতিশীল ছিল না। কাজেই হাদিসে যদি গায়িকা দাসীদের মালিক হওয়া ও বেচা-কেনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কোনো বাণী এসে থাকে, তাহলে তা এজন্য যে, ঘৃণিত দাসপ্রথা যেন বিলুপ্ত হয়ে যায়। সুতরাং এই হাদিসের প্রেক্ষিতে যদি প্রশ্ন তোলা হয় মিউজিক কি হালাল, উত্তর সহজেই অনুমেয়!

চ. মিউজিককে যারা হালাল মনে করেন না, তারা আরও দলিল দেন নাফে কর্তৃক ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত হাদিস দ্বারা। তাতে বলা হয়েছে,

“ইবনে উমর রা. একবার এক রাখালের বাঁশির শব্দ শুনতে পান, তখন তিনি তাঁর দুই কানে আঙুল দিয়ে রাস্তা পরিবর্তন করে অন্য রাস্তা দিয়ে তাঁর বাহন চালিয়ে যান। তখন তিনি বলছিলেন, ‘নাফে, তুমি কি (বাঁশির শব্দ) শুনতে পাচ্ছ?’ তখন আমি বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ।’ তখন তিনি আরও কিছু দূর চলে গেলেন। পরিশেষে যখন আমি বললাম, ‘এখন শোনা যাচ্ছে না’, তখন তিনি তাঁর দুই কান থেকে আঙুল বের করে নিলেন এবং বাহন পূর্বের রাস্তায় নিয়ে এলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘আমি রাসূল সা.-কে এক রাখালের বাঁশির শব্দ শুনে এরূপ করতে দেখেছিলাম।”[5]

ইমাম আবু দাউদ বলেন, “এ হাদিসটি মুনকার বা দুর্বল।” তবে হাদিসটি সহিহ হলেও তা গান হারামকারীদের পক্ষে না গিয়ে বরং বিপক্ষেই দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কারণ, বাঁশির শব্দ শোনা হারাম হলে রাসূল সা. কখনও ইবনে উমর রা.-কে তা শুনতে দিতেন না। আর ইবনে উমর রা.ও তা হারাম মনে করলে নাফেকে শুনতে দিতেন না। বরং নবি কারিম সা. অবশ্যই এ নিষিদ্ধ কাজ বন্ধ করার জন্য আদেশ দিতেন।

নবি কারিম সা. ইবনে উমর রা.-কে তা শুনতে দেওয়া থেকে প্রমাণিত হয় যে, তা শোনা হালাল। আর রাসূল সা.-এর তা না শোনার ব্যাপারটি ছিল দুনিয়ার অনেক মুবাহ বা বৈধ কাজ থেকে তাঁর বিরত থাকার মতোই। যেমন- তিনি কোনো কিছুর ওপর ঠেক লাগিয়ে পানাহার পরিহার করতেন, তাঁর কাছে দিনার ও দিরহাম রেখে ঘুমাতেন না ইত্যাদি। অথচ এসব কাজ মুবাহ বা বৈধ কাজ।

সুতরাং উপোরোক্ত দলিল ও আলোচনার ভিত্তিতে উত্তর অনুসন্ধান সহজ হয়ে গিয়েছে যে, মিউজিক কি হালাল নাকি হারাম?

মিউজিক কি হালাল – Is music Halal in Islam? (৩য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন)

[1] ইবনে হাজার, তাগলিকুত তালিক, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৭-২২, বৈরুত : মাকতাবাতুল ইসলামি থেকে প্রকাশিত।

[2] যাহাবি, মিযানুল ইতিদাল, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩০২। ইবনে হাজার, তাহযিবুত তাহযিব খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ৫১-৫৪

[3] দেখুন, ইবনে হাযমের আল মুহাল্লা-র গান সম্বন্ধে আলোচনায় এসব হাদিস নিয়ে তাঁর পর্যালোচনা- খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ৫৯।

[4] গাযালি, এহইয়াউ উলুমুদ্দিন, পৃষ্ঠা : ১১৪৮

[5] আহমাদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ

 

মিউজিক কি হালাল – Is music Halal in Islam?

ড. ইউসুফ আল কারজাভি

Leave a Comment